জানিনা “সুমন” কেন আমার প্রেমের রাজধানী
আমি নিজে গান
গাইতে পারিনা আর তথাকথিত সঙ্গীত শিক্ষিত নই। একটু আধটু সুর বুঝতে পারি আর তাই দিয়ে
চালিয়ে দি। তা দিন কয়েক আগে একজন তথাকথিত সঙ্গীত-শিক্ষিত ব্যক্তি আমাকে হঠাৎ ব্যাঙ্গাত্মক
সুরে বললেন- তুমি তো দেখছি কবীর সুমনের গানগুলো ভালোই কণ্ঠস্থ করেছ। তা আমি আর কি
বলি, ওনাকে বললাম, আসলে আপনার মত কণ্ঠস্থ করতে তো পারব না, তাই আত্মস্থ করেছি। উনি
কিছু না বুঝে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে চলে গেলেন। আসলে রবীন্দ্রনাথের গানের মতই সুমনের
গানও ভীষণ হিংসুটে, তার চাহিদা খুব বেশি। কিছুতেই তাকে ছাড়তে দিতে চায় না। কত
প্রেম-বিচ্ছেদ, বন্ধু-বিচ্ছেদ হয়ে গেল এই গানের জন্যে, কিন্তু গান কখন যে
ট্রান্সেন্ড করে যাচ্ছে কে জানে? তাই শুধু গান গুলো থেকে গেল।
আসলে বাংলা গানের
জগতে কবীরের প্রবেশের সময়টা খুব অদ্ভুত ছিল। বার্লিন প্রাচীর সবে ভেঙ্গেছে। আমেরিকা
আর সাদ্দামের লড়াই তখনও টেলিভিশন এর পর্দায় ভেসে আসছে। আর এই সময় ভারতে সবে মুক্ত
অর্থনীতির ছোঁয়া লেগেছে। কেবল টিভির হাত ধরে এক ঝটকায় পৃথিবীটা হঠাৎ ঘরের মধ্যে
ঢুকে এল। মৃণাল সেনের “মহাপৃথিবী” দেখে ফেলেছি, পনেরো বছর পর প্রিয়তম পুত্র
জার্মানি থেকে দেশে ফেরার দিন, উত্তর কলকাতার গলিতে বাস করা “মা” আত্মহত্যা করল
করল- কেন? মন প্রশ্ন করছে। উত্তর চাইছেনা- কিন্তু বক্তব্য চাইছে। “স্টেটমেন্ট”
চাইছে। ঠিক যে স্টেটমেন্টের আশায় ১৯৭৩ এর কোন বিকেলে প্যারিসের শ্যেন নদীর ধার
দিয়ে হেঁটে যাওয়া এক বাঙালি যুবক পেয়ে ছিল বব ডিলান কে, ঠিক সেইভাবে ১৯৯২ এর
এপ্রিলের এক দিনে আমারা পেলাম সুমন কে। গানের মধ্যে “স্টেটমেন্ট” – বক্তব্য। আমি
বলছি- তুমি ভাবো।
“একথা তুমি কি
ভাববেনা অনেক দিন গেছে দিনান্তে
তোমার আমার যত
চেতনা, মেলাতে হবে এই সীমান্তে...”
আমার এক প্রবাসী বাঙালি বন্ধু মৈনাক্য আমাকে
প্রথম সুমনের কথা বলে – সালটা ১৯৯০-৯১ হবে। মৈনাক্য রাঁচিতে বা অন্য কোথাও( জায়গা
টা ঠিক মনে নেই) সুমনের কোন অনুষ্ঠান দেখে ছিল। মৈনাক্য প্রবাসী ছিল তাই বাংলা
ভাষাতে অতোটা দক্ষ ছিলনা। ওর ভাষায় – “অদ্ভুত” কিছু গান ও শুনেছিল – একটা লোক একাই
গান গাইছে আবার নিজেই সব যন্ত্র বাজাচ্ছে। এর পর ১৯৯১ এর শেষাশেষি আমার থেকে
আত্মীয় – কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন,
ইউনিভারসিটি ইন্সিটিউট হলে সুমনের একটা অনুষ্ঠান দেখে। ওর ভাষ্য টা আমার
মনে আছে – সব অন্যরকমের গান – এ রকম আগে শুনিনি আবার দেখিওনি- জিলিপি আর সন্দেশ
নিয়ে গান । কি গান সেটা বলতে পারল না –
বলল লোকটা তিন ঘণ্টা গাইল আর গল্প করল –একা- মাঝে মাঝে আবার চুমু ছুড়ে দিচ্ছে
শ্রোতাদের দিকে। পরের বছর ২৫ শে এপ্রিল বিকেলে আমার বাড়িতে এসে ওই আমাকে ক্যাসেট
টা দিয়ে গেল –“ তোমাকে চাই” – বলল সেই লোকটার গান- একবার শোন। আমার কাছে একটা টেপ
রেকর্ডার ছিল যেটা তে ক্যাসেট অটো রিভার্স
হয়ে যেত – দুদিক ঘুরতেই থাকত।আমি রাত ১২ টার সময় চালিয়েছিলাম – সারারাত জেগে শুনছি
– ক্যাসেট চলেছে সাইড এ থেকে সাইড বি। ভোর ৬ টায় বন্ধ করলাম। আমার মতো কয়েক হাজার-লক্ষ
জীবনে “সুমন-যুগ” শুরু হল।
সুমন গানের সাথে নিয়ে এলেন এক শক্তিশালী
পরিবেশনা। কবীরের প্রবেশের আগে মঞ্চে বাংলা গান গাওয়া হত, কিন্তু অসাধারন গায়কির
সাথে যদি জুড়ে দেওয়া যায় এক অন্যধরনের পরিবেশনা, যা গানের কথার সাথে মানানশই,
তাহলে আসল গানটি এক অন্য মাত্রা পায়। ধরা যাক ১৯৯২ এর শুরুতে কবীর সুমনের গাওয়া “অনিতা
দেওয়ান” গানটির কথা। গানটির কথার সাথে পরিবেশনার যে ছোঁয়া সুমন মঞ্চে এনেছিলেন, তা
তার আগে বাংলা গানে চিন্তাও করা যেত না। এর ফলে গানের বক্তব্য মগজে ঢুকে যাচ্ছে, “কারফ্যিউ”
ভেদ করে। সেই সময় সুমনের এক একটা “একক” অনুষ্ঠান দেখা মানে একটা অদ্ভুত অভিজ্ঞতা।
আমি এই “অদ্ভুত” কথাটা বারবার বলি কারন তার গানের এই মিশ্রিত প্রভাবের জন্য। গান
আমাকে ভাবতে শেখাচ্ছে।গানের বক্তব্য আমাকে চিন্তার জাল গুলো ছিঁড়ে ফেলার
অনুপ্রেরণা যোগাচ্ছে। প্রেক্ষাগৃহ থেকে বেড়িয়ে আমি গান নিয়ে ভাবছি। সেই গান আমি
কণ্ঠস্থ করিনি- আত্মস্থ করেছি।
আসলে কবীর সুমন
তার গানের সাথে গানের শ্রোতা তৈরি করেছিলেন এবং খুব সচেতন ভাবে করেছিলেন। তাই
কোথায় যেন রবীন্দ্রনাথের সাথে সুমন মিলে যান। মা রবীন্দ্রনাথ এর গান গাইতেন- তার
মধ্যেই থাকতেন। সেখানেও থেকে যায় আত্মস্থ করার ইতিহাস। আজ আমার মত অনেকেরই বয়েস
বাড়ছে, যারা আমার মতই “সুমন- যুগে” বেড়ে উঠেছেন, কবীরের গানকে আত্মস্থ করেছেন। দিন
শেষ হয়, সারা দিনের হারা- জেতার হিসেব নিকেশ লেখা হয়, রাত্রি নামে, আলো নিভে যায়,
নিস্তন্ধ আকাশের বুকে তারা রা জেগে থাকে। আর থেকে যায় গান – সুমনের গান।
“ জানিনা বয়েস হলে কেন প্রেমে এত পাক ধরে
জানিনা হৃদয় কেন রাত জেগে পায়চারী করে
...জানিনা “সুমন” কেন আমার প্রেমের রাজধানী
উত্তর আসবেনা, তুমি আসবেই আমি জানি...”
Comments
Post a Comment