কবীর সুমন, বাংলা খেয়াল আর কিছু কথা...
কবীর সুমন এবং তার গান
সম্বন্ধে আমি মাঝেমাঝে কিছু লেখালেখি করি। কবীর সুমনের ওপর আমার নিজের একটা পেজ ও
আছে। তাতেও মাঝেমাঝে লিখি। খুব সীমিত কিছু মানুষ আমার লেখা পড়েন। ঠিক যেমন সুমনের
গানও খুব কম লোক শোনেন। অনেকে শুনেও কিছু বোঝেন না (এই না বোঝা লোকের সংখ্যা
প্রচুর)। আমরা সংখ্যায় লঘিষ্ঠ। সেই ১৯৯২ থেকে কলামন্দিরে কবীরের একক অনুষ্ঠানগুলিতে
প্রায় এক মুখগুলি চোখে পড়ত। ২০০৪ থেকে আমি প্রবাসী, এবং আমি দেখেছি সর্বত্রই
সুমনের শ্রোতা সংখ্যা সীমিত। সেটা স্বাভাবিক, কারণ যারা থুম্বা, ক্যানেস্তারা
চাইছেন তাদের পক্ষে সহজ সুরের শয়তানি বোঝা সম্ভব নয়। তাদের গোড়ায় গলদ আছে।কারন সুমন কে বোঝার মত মেধা – চিন্তা খুব সীমিত সংখ্যক বাঙালির আছে। তার অপর আমাদের মজ্জায় রয়েছে – হিংসে – তা থেকে বেরবো কি করে?শুধু শিক্ষা দিয়ে সুমন কে বোঝা যায়ে না তার জন্য চাই – মননশীলতা – সংবেদনশীল মানসিকতা।
আসলে এভাবে কেউ সুমনের আগে বলেননি।কারন - পৃথিবী যে নিয়মে চলছে , সে ঠিক সে নিয়মে চলেনা – তাকে সহজে বোঝা যায়ে না , তার ভাবনা অন্য রকম। আসলে সেই ষাট – সত্তরের দশক গুলো আমাদের জীবনে একটু অন্যরকম ছিল তাই নয় কি? ভাষা পাল্টানোর সময় – কবিতার ভাষা পাল্টাচ্ছে, সিনেমার ভাষা পাল্টে যাচ্ছে , গ্রুপ থিয়েটার এসে গেছে , রাজনীতির ভাষা পাল্টাচ্ছে – কিন্তু কথার দিক থেকে বাংলা গান কিন্তু এক জায়গাতে দাঁড়িয়ে ছিল।অনেক ভালো সুর তৈরি হয়েছে কিন্তু গানের কথা সময়ের সাথে পাল্লা দিতে পারছিল না। কয়েকজন হয়ত বিক্ষিপ্ত ভাবে চেষ্টা করেছিলেন – কিন্তু বেশী প্রভাব ফেলতে পারেন নি। আর এখানেই সুমন – যে কথা আমার দৈনন্দিন জীবনের - সেই কথাই গানে নিয়ে এলেন। জিলিপি , সন্দেশ , বেশ্যা , দালাল, টোটো – কোম্পানি , পায়রা পোষেন ,খ্যাঁকানি, রুটি- বিস্কুট ইত্যাদি – এই সব কথা যে গানের মধ্যে রাখা যেতে পারে তা সুমনের আগে বাঙালি কল্পনা করতে পারেনি। আবার কথাগুলো রোজকার ব্যবহারিক , কিন্তু মোড়কটা সর্বোচ্চ স্তরের – আর তার সাথে মিশে আছে এক প্রবল শক্তিশালী পরিবেশনা - আর সেখানেই সুমন আর সুমনের গান।
আজ আবার এক ভাষা পরিবর্তনের ইতিহাস লিখছেন কবীর - বাংলা
কথায় খেয়াল। এই চিন্তাও তার আগে কেউ করেন নি। সুমনের বাংলা খেয়ালের কোন অনুষ্ঠান
আমি নিজে এখনও সামনে বসে দেখিনি বা শুনিনি। কিন্তু টেকনোলজির এই মহাযুগে
ইন্টারনেটের মাধম্যে আমিও এই ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে চলেছি- প্রতিমুহূর্তে। সুরের সপ্তকে “কলকাতার
বুকে সন্ধ্যে নামছে মাইকেলের কবর ছুঁয়ে”। সুরের প্রকাশ ঘটছে আবাহনে – “এসো এই রাতে
নয়নতারা জ্বালো / তোমার চোখে দেখি ভুবনভরা আলো”। না – এভাবে, এই কথা বসিয়ে এর আগে
কেউ বাংলা খেয়াল তৈরি করার কথা কেউ চিন্তাও করেননি। তার কারন এই প্রতিভা আর
যোগ্যতা তাদের ছিলনা। বন্দিশ গুলি শুনলে বোঝা যায় কি অসাধারন দক্ষতার সঙ্গে কবীর
সুরের মধ্যে কথার সমকালিনতার প্রকাশ ঘটাচ্ছেন। সেই কথায় টানছে, কথার এক্কা, খালি
সুরের প্রয়োগ পাল্টে যাচ্ছে। “ সন্ধ্যে পেরিয়ে আসে রাত/ রাস্তার আলো আরো একা” – এই
কথা সুমন বসাচ্ছেন তার বন্দিশে। এ যেন এক যুদ্ধ – ভাষার যুদ্ধ – মাতৃভাষার সাথে
নিজের যুদ্ধ, নিজেকে প্রকাশ করার যুদ্ধ। পঁচিশ বছর পরে আবার যুদ্ধে নেমেছেন প্রবীন
প্রেমিক- আর আমরা আবার সেই যুদ্ধের সহযাত্রী।
“আমি চলে যাব থেকে যাবে ভাষা
আমার স্বপ্ন আমার পিপাসা-
যেন চায় কেউ কখনও শ্রাবনে
ভাষার ধারায় নাইতে
ওরা যদি পারে আমরাও পারি
আমাদের ভাষায় গাইতে
বাংলার ধ্বনি, ভাষার মেজাজ
এই খেয়ালেই চাইতে...”
আমার স্বপ্ন আমার পিপাসা-
যেন চায় কেউ কখনও শ্রাবনে
ভাষার ধারায় নাইতে
ওরা যদি পারে আমরাও পারি
আমাদের ভাষায় গাইতে
বাংলার ধ্বনি, ভাষার মেজাজ
এই খেয়ালেই চাইতে...”
-কবীর সুমন
Comments
Post a Comment