পঁচিশ পেরল তোমাকে চাই


দেখতে দেখতে পঁচিশ বছর  কেটে গেল আর আমাদেরও বয়স বাড়লতোমাকে চাইএর হাত ধরে। আবার পেছনে তাকানোর সময়। অনেকেই অনেক কিছু লিখে ফেলবেন এই সময়। নতুন অনেকসুমনায়িতকবিতায় পাতা ভরবে। আর আমরা, যাদের মনন, এই সুমন-যুগে , প্রতিদিন নিঃশ্বাস নিয়েছে প্রান ভরে, তারা আবার স্মৃতির পাতায় পা রাখবে। সেই পুরনো কথা গুলো আবার একটু নতুন মোড়কে ফিরিয়ে নিয়ে আসা। সুমনেরই ভাষায় –“ স্মৃতি সতত সুখের কিনা কে জানে, কিন্তু এক ধরনের দুঃখের মধ্যেও যেন একটা আনন্দ থেকে যায়।

আমার এক প্রবাসী বাঙালি বন্ধু মৈনাক্য আমাকে প্রথম সুমনের কথা বলেসালটা ১৯৯০-৯১ হবে। মৈনাক্য রাঁচিতে বা অন্য কোথাও( জায়গা টা ঠিক মনে নেই) সুমনের কোন অনুষ্ঠান দেখে ছিল। মৈনাক্য প্রবাসী ছিল তাই বাংলা ভাষাতে অতোটা দক্ষ ছিলনা। ওর ভাষায় – “অদ্ভুতকিছু গান শুনেছিলএকটা লোক একাই গান গাইছে আবার নিজেই সব যন্ত্র বাজাচ্ছে। এর পর ১৯৯১ এর শেষাশেষি আমার থেকে আত্মীয়কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন, ইউনিভারসিটি ইন্সিটিউট হলে সুমনের একটা অনুষ্ঠান দেখে। ওর ভাষ্য টা আমার মনে আছেসব অন্যরকমের গান রকম আগে শুনিনি আবার দেখিওনি- জিলিপি আর সন্দেশ নিয়ে গান কি গান সেটা বলতে পারল না বলল লোকটা তিন ঘণ্টা গাইল আর গল্প করলএকা- মাঝে মাঝে আবার চুমু ছুড়ে দিচ্ছে শ্রোতাদের দিকে। পরের বছর ২৫ শে এপ্রিল বিকেলে আমার বাড়িতে এসে ওই আমাকে ক্যাসেট টা দিয়ে গেল –“ তোমাকে চাই” – বলল সেই লোকটার গান- একবার শোন। আমার কাছে একটা টেপ রেকর্ডার ছিল যেটা তে ক্যাসেট অটো রিভার্স হয়ে যেতদুদিক ঘুরতেই থাকত।আমি রাত ১২ টার সময় চালিয়েছিলামসারারাত জেগে শুনছিক্যাসেট চলেছে সাইড থেকে সাইড বি। ভোর টায় বন্ধ করলাম। আমার মতো কয়েক হাজার-লক্ষ জীবনেসুমন-যুগশুরু হল।


কিন্তু সুমন তে এলেনএবং ইতিহাস তৈরি করলেন - একা। কিন্তু বাঙালি কি করল? প্রথমে চেষ্টা করল যাতে সে ঢুকতে না পারে।দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে যে কড়া নারে, দরজা না খুলে দিলে সেতো ঢুকতে পারবেনা , কিন্তু সে যদি ঢুকতে চায় আর তার যদি জোর থাকে তাহলে সে দরজা ভেঙ্গে ঢুকে যাবে। ১৯৯২ তে খবরের কাগজেতোমাকে চাইএর বিজ্ঞাপন ছিল এই রকম – “ সুমনের গানএক ঝটকা বাতাস “ – আসলে ওটা বাতাস ছিলনা ওটা ছিল ঝড়- কাল- বৈশাখী।আমার- তোমার ভাবনার - চেতনার আঙ্গিনা লণ্ডভণ্ড করে দেওয়া ঝোড়ো হাওয়া।
সুমন একা ঢুকে পড়লেন বাংলা গানের জগতে। এবার এইসঙ্গীতশিক্ষিত”  বাঙালি কি করবে? খুব ঝামেলা যেআরে দেখছি আমেরিকা ফেরত- বব ডিলানের নাম করছে। ওকে ডিলানের সাথে জুড়ে দাওতাড়াতাড়ি।কিন্তু ১৯৯৩ এর সুমন , মতর যুদ্ধে যেন ডিলানের মত- শুধু ওপরের মোড়কটা কিন্তু সুমনের গান লেখার শুরু ডিলান থেকে যা সুমন বারবার বলে এসেছেন। আর বাঙালির জন্য কোথায় যেন ডিলান কথাটা দরকার ছিল১৯৯৩ এর সেই পরিবর্তনের সময় আরও বেশি করে।আর যদি ফিরে যাই ১৯৭৩ এর কোন এক বিকেলে প্যারিসের শ্যেন নদীর ধার দিয়ে হেঁটে যাওয়া কোন যুবকের মনে –“ বব ডিলানের গান শুনছি জীবনে প্রথমবার। দেশের সেপাইদের বন্দুকের সামনে, তাদের গালাগালির সামনে ভয়ে কেঁপে কেঁপে ওঠা সেদিনের সেই ছোট্ট ছেলে , তুমি কি কখনও শুনতে পেয়েছ এই গান ?” -  “আলখাল্লাতে কবীর সুমন , যেখানে ডিলান মিশছে বাউল আর কীর্তনের সাথে। ১৯৯৩ তে সুমন গানে যে কথা নিয়ে এলেন তাতে তিনি মিলিয়ে দিলেনডিলান, রবীন্দ্রনাথ , বাউল, কীর্তন আরসুমনকে। সুমনের সাথে ডিলানের সরাসরি তুলনা শুরু হল কিছু গানের জন্য আর সুমন এইমত যুদ্ধে মাঝে মাঝেইকত টা পথগাইবার সময় বলে উঠতেনএই একটি গানে কিন্তু সুমন- ডিলানের মতযদিও আমি করেছি পাঁচ মাত্রার তালআপন মনের মাধুরী মিশায়ে।


 আসলে সুমন বাংলাতে গান তৈরি জন্য আমাদের মনন সমৃদ্ধ হয়েছে কোন সন্দেহ নেই- কিন্তু বাঙালি সুমন কে তার প্রাপ্য সন্মান দিতে চূড়ান্ত ব্যর্থ হয়েছে শুধু সুমন বলে না রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কার টি না পেলে পাড়ার মোড়ে মোড়ে এই রবীন্দ্রচর্চা হতোনা ডি এল রায়ের মতো আর অনেকে রবীন্দ্রনাথের গানের কুৎসিত প্যারোডি করে আমাদের শুনিয়ে যেতেন। একই কথা বিবেকানন্দের শিকাগো মহাসভার ভাষণ আর সত্যজিৎ রায়ের অস্কার পাবার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। বিদেশ থেকে কিছু না পেলে আমরা যে চোখ তুলে তাকাইনা- এটা বাঙালির শত বছরের অভ্যাস। সুমনের অসাধারন সঙ্গীতবোধ কে নিংড়ে নিতে বাঙালি ব্যর্থ আজ অবধি কটা বাংলা সিনেমাতে সুমন কে ব্যবহার করা হয়েছে ? হাতেগোনা গুটি কয়েক। কারন সুমন কে বোঝার মত মেধা চিন্তা খুব সীমিত সংখ্যক বাঙ্গালির ছিল। তার অপর আমাদের মজ্জায় রয়েছে হিংসে তা থেকে বেরবো কি করে?শুধু শিক্ষা দিয়ে সুমন কে বোঝা যায়ে না তার জন্য চাই মননশীলতা সংবেদনশীল মানসিকতা। মনে আছে ১৯৯৩ এর ফেব্রুয়ারী তে টিভি তে প্রথম সাক্ষাৎকারে সুমন দেবাশিষ কে বলছেন- “... আমার পলায়াণী মনোভাব ,কতো ছেলেমেয়ে মরে গেল দেবাশিষ আমি কিন্তু এক্ টা ধার করা স্যুট পরে একটা চাকরির ইন্টারভিউ দিতে গেলাম- আর তাতে তখনও দর্জির লাল দাগটা লেগে ছিল” – এই অনুভব টা এখান থেকেই তৈরি হয় পালটে দেওয়ার ইচ্ছে কিন্তু পালটে দেওয়াটা সহজ না- ইচ্ছের সাথে দরকার প্রতিভা, যোগ্যতা আর জেদ যেটা সুমনের ছিল। তাই সুমন বলছেন – “আমি বুঝলাম আমাকে যদি গাইতে হয় বাংলা গান সে গান আমাকে লিখতে হবে, সুর করতে হবে আজকের এই টেকনোলজীর মহাযুগে , বিশ্বব্যাপী ইন্টারনেট এর সময় অনেক কিছু সহজ লাগতে পারে কিন্তু আজ থেকে তিরিশ চল্লিশ বছর আগে তা ভাবা শক্ত ছিল। কিছু জানতে গেলে এক্ টা সিধু জ্যাঠা কে দরকার হত।সেই সময় দাঁড়িয়ে একটা লোক গানের ভাষা পালটানোর ইচ্ছে সম্বল করে দেশে ফিরে এলো এবং যেটা আমাদের শোনাল সেটা তো আগে কেউ পারেনি- এটা গ্রহন করার মতো সৎ সাহসঅনেকের ছিলনা। তা নয়ত আমাদের ধুতি ধরে টানাটানি শুরু হবে যে। বহুকাল তো আমার বাবার সময় হল দাও বিদায়বলে কাটিয়ে দিয়েছি এবার তো আমার যাবার সময় হলবলতেই হবে। তাই জীবন মুখী” , সে- মুখী তকমা দিয়ে এড়িয়ে যাও।১৯৯২ তে একটা লোক এসে একা একটা প্রায় তলিয়ে যাওয়া গানের জগৎ কে ( বাংলা গান তখন গভীর জলে খাবি খাচ্ছে) ওপরে তুলে , রকেট টাকে অন্তরীক্ষে পাঠিয়ে দিল একা। মনে পড়ে ১৯৯২ তে তোমাকে চাই বেরনোর পর বাংলা গানের জগতে তার প্রভাবটা?তারপর কি হল ? আমাদের মহান বাবু-বিবিদের কল্যানে সেই রকেট তো দক্ষিন-চব্বিশপরগনার বুকে আছড়ে পড়ল। আসলে দেশটা বেরসিকে ভরে গেছে।আর যদি ইংরাজি তে লেখার কথা /গানের কথা হয় তো যারা সুমনের রিচিং আউট শুনেছেন তারা জানেন যে কি মানের অ্যালবাম ছিল সেটা কজন বাঙালি শুনেছে ? ওই অ্যালবাম আমেরিকা থেকে বেরোলে সুমন গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ড পেয়ে যেতেন আর সারা পৃথিবী যাকে কুর্ণিশ করছে সেই পিট সিগার সুদুর আমেরিকা থেকে কলকাতা চলে এলেন শুধু সুমনের জন্য আর আমরা কি করলাম ? বাবা! এতো মস্তবড় লোক রে একেবারে পিট সিগার এড়িয়ে চল ভাই এড়িয়ে চল। পিট জানতেন , বুঝতেন সুমনের প্রতিভা , তাই পিট সিগার সুমন কে আমেরিকা ছাড়তে বারন করেছিলেন।


সারা পৃথিবীতে মনে হয় খুব কম শিল্পীরই তার জীবদ্দশাতে এত সংখ্যক সৃষ্টি প্রবাদের মত হয়ে উঠতে পেরেছে - সুমন তাদের মধ্যে অন্যতম।ভরসা থাকুক”, “ চল্লিশ পেরলেই চালশে” , “ দশ ফুট বাই দশ ফুট” – এই রকম বহু গানের কথা প্রবাদের মত হয়ে আমাদের জীবনে অঙ্গাঙ্গিক ভাবে জড়িয়ে আছে। আরএক কাপ চায়ে আমি তোমাকে চাইতো ১৯৯২ এর এপ্রিল এর পর বাঙালীর জীবনে ভালোবাসা প্রকাশের অপর নাম হয়ে গেছে। আবার সময়ের সাথে অনেক কিছু পালটে যায়কিন্তু কথা থেকে যায়। যেমনআমাদের জন্যগান টি মানেই গড়িয়াহাটের মোড়কিন্তু সেই মোড়ের মজা তো আর নেইওপরে যে এখন ফ্লাইওভার। তবু গান থেকে যায় আর স্মৃতির পাতায় থেকে যায় গড়িয়াহাট এর সেই মোড় যা শুধুআমাদের জন্য

আসলে এভাবে কেউ সুমনের আগে বলেননি।কারন - পৃথিবী যে নিয়মে চলছে , সে ঠিক সে নিয়মে চলেনাতাকে সহজে বোঝা যায়ে না , তার ভাবনা অন্য রকম। আসলে সেই ষাটসত্তরের দশক গুলো আমাদের জীবনে একটু অন্যরকম ছিল তাই নয় কি? ভাষা পাল্টানোর সময়কবিতার ভাষা পাল্টাচ্ছে, সিনেমার ভাষা পাল্টে যাচ্ছে , গ্রুপ থিয়েটার এসে গেছে , রাজনীতির ভাষা পাল্টাচ্ছেকিন্তু কথার দিক থেকে বাংলা গান কিন্তু এক জায়গাতে দাঁড়িয়ে ছিল।অনেক ভালো সুর তৈরি হয়েছে কিন্তু গানের কথা সময়ের সাথে পাল্লা দিতে পারছিল না। কয়েকজন হয়ত বিক্ষিপ্ত ভাবে চেষ্টা করেছিলেনকিন্তু বেশী প্রভাব ফেলতে পারেন নি। আর এখানেই সুমনযে কথা আমার দৈনন্দিন জীবনের - সেই কথাই গানে নিয়ে এলেন জিলিপি , সন্দেশ , বেশ্যা , দালাল, টোটোকোম্পানি , পায়রা পোষেন ,খ্যাঁকানি, রুটি- বিস্কুট ইত্যাদিএই সব কথা যে গানের মধ্যে রাখা যেতে পারে তা সুমনের আগে বাঙালি কল্পনা করতে  পারেনি। আবার কথাগুলো রোজকার ব্যবহারিক , কিন্তু মোড়কটা সর্বোচ্চ স্তরেরআর তার সাথে মিশে আছে এক প্রবল শক্তিশালী পরিবেশনা - আর সেখানেই সুমন আর সুমনের গান।

কিছু খণ্ড খণ্ড চিন্তায়, স্মৃতির অলিতে গলিতে সুমন।আমার জিতে নেওয়া সকাল বা হেরে যাওয়া বিকেলে জুড়ে আছেন সুমন। আমার প্রেমে- অপ্রেমে, আবেগে, রাগে, ঘৃণা , লজ্জায় , আনন্দে, দুঃখেসবেতেই সুমনের ছোঁয়া।সুমন এর কোনওফ্যানহয় না , শুধুশ্রোতাহয়।সুমন এর গানশুধু গান নয়একটা সময় এর ইতিহাস , পালটে দেওয়ার ইচ্ছে আর তার সাথে মিশে আছে দম্ভ। হ্যাঁসুমন দাম্ভিক আর তার সাথে আমরা সুমনএর শ্রোতা রাও দাম্ভিককারন আমরা সুমন কে শুনেছি আর বুঝেছি। শুধু শিক্ষা দিয়ে সুমন কে বোঝা যায়ে না তার জন্য চাইমননশীলতাসংবেদনশীল  আর আপনাকে বাংলা শব্দ গুলোকে ভালবাসতে হবেঅক্ষরগুলোর সাথে প্রেম করতে হবেতাহলে পৃথিবীর যে প্রান্তেই আপনি থাকুন না কেন- আপনিসুমনএই থাকবেন বন্ধু। আর আমার দাম্ভিক মন বলুক - “ পৃথিবী যে নিয়মে চলছে , সে ঠিক সে নিয়মে চলেনাতাকে সহজে বোঝা যায়ে না , তার ভাবনা অন্য রকম।


শঙ্খ

২৩.০৪.২০১৭

Comments

Popular posts from this blog

জানিনা “সুমন” কেন আমার প্রেমের রাজধানী

কবীর সুমন, বাংলা খেয়াল আর কিছু কথা...

একক সুমন – কিছু কথা, কিছু স্মৃতি...