“তোমাকে চাই” ...পঁচিশ...আরও কিছু কথা...



পঁচিশ পেরল “তোমাকে চাই”। আর বিগত পঁচিশ বছর ধরে বাংলা গান নিঃশ্বাস নিল “সুমনে”। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায় তাতে বাংলা গান কতটা কতটা সমৃদ্ধ হল? বা বাংলা গানের শ্রোতারা সুমন থেকে কি নিতে পারল। একটু ফিরে দেখা যাক বাংলা গানের জগতে কবীর সুমনের অনুপ্রবেশের সময়টা। আশির মাঝামাঝি থেকে বাঙালি শ্রোতারা বাংলা গান থেকে মুখ ফেরাতে শুরু করেন। তার কারন গানের কথা। এই সময় বাংলা গানের কথার মান নামতে শুরু করে।  ধরা যাক ১৯৮৯-৯০ এর একটা বাংলা সিনেমার গান- “বুকুন ওগো বুকুন, তোমার মাথায় বাচব বসে – ভালবাসার উকুন”। কি সুন্দর শ্রুতিমধুর গান বলুন তো? আর ভেবে দেখুন এর কিছু বছর আগেই মুকুল দত্ত লিখছেন “ অনেক সুখে এখন আমার চোখে এলো জল, সেই চোখের জলে মালা গেঁথে গলায় পড়িলাম”এই গানের কথার মধ্যে সেই সময়ের ভাষা না থাকলেও তা শ্রুতিমধুর ছিল। কিন্তু তা থেকে দশ বছরের মধ্যে বাংলা গান বুকুনের মাথার উকুনে পৌঁছে গেলো কি করে? এর পিছনের ইতিহাস একটু দেখার দরকার আছে।

আসলে বাংলা গানের ভাষা পরিবর্তনের চেষ্টা সেই ভাবে কেউ করেন নি। সুর নিয়ে অনেক প্রয়াস আছে- অনেক ভালো ভালো সুর তৈরি হচ্ছিল কিন্তু গানের ভাষা কিছু বলছিল না। পঞ্চাশ আর ষাটের দশকের গানের কথা সম্পূর্ণ না হলেও আংশিক ভাবে রবীন্দ্র – প্রভাবিত ছিল। কিন্তু এই পঞ্চাশ আর ষাটের দশক বাঙালির পরিবর্তনের যুগ। সত্যজিত আর ঋত্বিক এর হাত ধরে সিনেমার ভাষা পাল্টেছে, কবিতার ভাষা পাল্টেছে – সুভাস এসে গেছেন- শঙ্খ লিখছেন যে। আবার গ্রুপ থিয়েটার এসে গেছে- তাই নাটকেরও ভাষা পাল্টে গেছে। কিন্তু বাংলা গান নতুন কিছু বলেনি। কেউ কেউ বিচ্ছিন্ন চেষ্টা করলেও এর প্রভাব পড়েনি। আর তার সাথে ছিল হিন্দির প্রভাব। মনে রাখতে হবে আশির দশকের প্রথম দিকে আমাদের জীবনে ঢুকে পরেছে টেপ রেকর্ডার। এবং তার সাথে হিন্দির প্রভাব। আমরা কিন্তু গুলজারের লেখা গান শুনে ফেলছি। আবার “ঘরোন্দার” মত সিনেমার গান আমাদের জীবনে ঢুকছে যার কথা সমকালীন। এই সময় থেকে মধ্যবিত্ত বাঙালি , বাংলা গান থেকে মুখ ফেরাতে শুরু করে এবং তা প্রবল হয় আশির দশকের শেষাশেষি ইংরাজি গানের সহজলভ্যতার ফলে। কারন আমাদের জীবনে ঢুকে পরল ফিল কলিন্স বা ব্রুস স্প্রিংস্টিন – খুব সহজ ভাবেই। তাই গানের কথার সমকালিনতার আশায় আমরা হয় চলে গেছি পাশ্চাত্যের কাছে আবার সুরের আশায় আর কথার শ্রুতিমধুরতার জন্য ফিরে গেছি হেমন্ত- মান্নার যুগে – নতুন বাংলা গানের কাছে নয়।



এই সময় কবীর সুমন এলেন ঝড়ের মত। একা একটা লোক – একাই গানের জগত। তোমার আমার জীবন থেকে নেওয়া গানের কথা – অথচ ওপরের মোড়কটা সর্বোচ্চ স্তরের। কখনও আধুনিক , কখনও রবীন্দ্রনাথ আবার হিমাংশু দত্ত আর তার সাথে মিশে আছে এক অন্য ধরনের পরিবেশনা। কিন্তু আসল হল গানের কথা। তাই যারা কথার কাঙাল তারা প্রথমেই ঘুরে বসল আর তার সাথে ভালো গানের শ্রোতারা। কিন্তু তারা সংখ্যায় কম। একটা বিশাল সংখ্যক বাংলা গানের শ্রোতা তখনও “ঝিঙ্ক চ্যাকে” মেতে আছে। আর যারা সুমনের প্রতিভা দেখে ঘাবড়ে গেলো তারা বলতে শুরু করল এটা “আসল” গান নয়। হায় বাঙালি! আর এদের দরকার ছিল আর একজনকে – আর পরের বছর পেয়ে গেলেন শ্রী নচিকেতা চক্রবর্তী কে। বেশ! কেল্লা ফতে।তোমাকে চাই – এর ক্যাসেট এর ওপর আধুনিক বাংলা গান লেখা ছিল – জীবনমুখী বলে কোন শব্দ ছিলনা। কিন্তু পরের বছর নচিকেতা চক্রবর্তী তার এই বেশ ভালও আছি অ্যালবাম এ জীবনমুখী বাংলা গান কথাটি ব্যবহার করেন। আর যারা তার পর থেকে সুমন আর নচিকেতা কে এক করতে চাইলেন – নিজেদের সুবিধার্থে – তারা সুমনের গান কেও জীবনমুখী বলতে শুরু করলেন। এটা সুমনের গান কে এড়িয়ে যাবার একটা চেষ্টা – যেটা এক শ্রেণীর বাঙালি আজও করে চলেছেন। তাতে অবশ্য আজ আর কিছু আসে যায়ে না – কারন কবীর সুমন কে যারা বুঝলনা বা বুঝতে চাইলনা – ক্ষতিটা তাদের – কবীর সুমনের নয়।

আসলে ক্ষতি যা হবার তা প্রথমেই হয়ে গেছে। ১৯৯৫ সালে  হৈমন্তী শুক্লা সুমনের কথায় ও সুরে “সবুজের প্রতিশোধ” নামে একটি অ্যালবাম করেন। কিছু অসাধারন গান তৈরি করেছিলেন সুমন। অনেক চলেছিল। কিন্তু আমি কোনদিন হৈমন্তী শুক্লা কে কোথাও ওই অ্যালবাম এর একটি গানও গাইতে শুনিনি। এই কথা শ্রীমতী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় এর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তিনি নিজে কবীর সুমনের সুরে অনেক গান রেকর্ড করেছেন, তথাকথিত “হিট” হয়েছে, কিন্তু তাকেও আমি কোন অনুষ্ঠানে সুমনের তৈরি কোন গান গাইতে শুনিনি। তার কারন জানিনা- কিন্তু এতে সব থেকে বেশি ক্ষতি হয়েছে বাংলা গানের।

আসলে কবীর সুমনের শ্রোতার সংখ্যা কম আর তার ফলে বাঙালির তথাকথিত “ইন্টালেক্টুয়াল” ভাবের ওপর একটা প্রশ্নচিহ্ন এসে পড়ে।আসলে বাঙালি কি কোনদিন রবীন্দ্রনাথ পড়েছে? সেলফ এর পর সেলফ তো ভরেছে বই কিনে- কিন্তু পড়ছে কজন? খুব কম। তারাই ভিড় জমাচ্ছে গ্রুপ থিয়েটার এর লাইন থেকে শুরু করে কলামন্দিরে। আর বাকিরা? তারা “ঝিং চ্যাকে” ব্যস্ত।

আমি নিজে দেখেছি বাংলার মধ্যে এবং বাংলার বাইরে আমার চারপাশে হাতে গোনা কিছু শ্রোতা সুমনের গান শোনেন। বাকিরা শোনেন না। তাদের অনেকেই ইংরাজি হরফে বাংলা গানের কথা পড়ে নিয়ে বাংলা গানও গেয়ে থাকেন। আসলে এরা চারপাশের দেওয়ালে লাল-নীল রঙ দেখেন হয়ত , কিন্তু “ভায়ের” মুখ দেখতে পান না। তাই এদের কানে সুমন প্রবেশ করেনা। বা করলেও তারা বোঝেন না। আসলে বাংলা শব্দ গুলোকে না ভালবাসলে কবীর সুমন কে বোঝা যায়না আর মনে হয় বাঙালিদের মধ্যে এই ভাষা প্রেমিকের সংখ্যা বরাবরই কম। ওই ইংরাজি হরফে বাংলা গান গাওয়া আর কি? এ ভাবে এড়িয়ে গিয়ে গিয়ে  একশ্রেণীর বাঙালি কিছুদিন পরে আবার “বুকুন আর তার উকুনে” ফিরে যাবে। আর সুমন ইতিহাস তৈরি করে যাবেন আর আমরা সেই ইতিহাস গাথা লিখে যাবো একই ভাবে। আর ইতিহাসের সহযাত্রীরা ? “তোমাকে চাই” বলে যে ইতিহাসের যাত্রা শুরু, সেখানে - তুমি আসবেই আমি জানি।

Comments

Popular posts from this blog

জানিনা “সুমন” কেন আমার প্রেমের রাজধানী

কবীর সুমন, বাংলা খেয়াল আর কিছু কথা...

একক সুমন – কিছু কথা, কিছু স্মৃতি...